বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আফ্রিকান শান্তি মিশন

রায়হান আহমেদ তপাদার:
ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্য নিয়ে সাতটি আফ্রিকান দেশের নেতা মিলে এক শান্তি মিশন শুরু করেছেন। প্রথমে ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং পরে ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন। এ মিশনের প্রথম পর্বে তারা একটি ট্রেনে করে পোল্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন কিয়েভে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, সেনেগাল, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, কমোরোস, জাম্বিয়া আর উগান্ডার নেতারা। এমন এক সময় এ সফর হচ্ছে, যখন ইউক্রেন সবেমাত্র তাদের বহুল আলোচিত পাল্টা অভিযান শুরু করেছে যার লক্ষ্য পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের যেসব ভূমি এতদিনের যুদ্ধে রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা। এমন এক সময়ে এই মিশনের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব সেটা একটা প্রশ্ন। তারা যখন ইউক্রেনে পৌঁছান, ঠিক তখনই দেশটির রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলার সতর্ক সংকেত দিতে সাইরেন বেজে ওঠে এবং ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে, কৃষ্ণসাগর থেকে বেশ কয়েকটি রুশ কালিবর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। শহরের পডিলস্কি এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা বলেন, এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছিল ‘আফ্রিকার প্রতি রাশিয়ার বার্তা’ যে পুতিন ‘আরও যুদ্ধ চান, শান্তি নয়’। একজন কূটনীতিক ওলেক্সান্দর শেরবা এক টুইট বার্তায় বলেছেন, কিয়েভে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মাধ্যমে আফ্রিকান নেতাদের স্বাগত জানাচ্ছেন পুতিন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত মাসে যখন এই আফ্রিকান শান্তি মিশনের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা সময়সীমার কথা বলেননি।

চীন ও তুরস্কের নেতারা এবং পোপ ফ্রান্সিস এ রকম অনেকেই আছেন সেখানে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক কিংসলে মাখুবেলা প্রশ্ন তোলেন, আফ্রিকান নেতাদের এই উদ্যোগের কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুটা কী? এটা স্পষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণত আফ্রিকার নেতাদের সক্রিয়তা দেখা যায় না। সেদিক থেকে এই উদ্যোগ একটা বিরল ঘটনা। কারণ ইউক্রেন সংকটকে সাধারণত দেখা হয় রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার একটা সংঘাত হিসেবে। গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক মুরিথি মুথিগা বলছেন, আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে ঘটনা নিয়ে এ কূটনৈতিক উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান। এই উদ্যোগের ভিত্তি স্থাপন করেছেন ব্রাজাভিল ফাউন্ডেশন নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান জঁ-ইভেস অলিভিয়ের। তিনি অবশ্য খুব বেশি বড় কোনো লক্ষ্যের কথা বলছেন না। তার মতে, লক্ষ্যটা হচ্ছে একটা সংলাপ শুরু করা, তা ছাড়া রুশ ও ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দি বিনিময়ের জন্য কাজ করা। বিবিসির বিশ্লেষক অ্যারন আকিনিয়েমি বলছেন, আফ্রিকান নেতাদের এই ইউক্রেন শান্তি মিশন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন আফ্রিকান দেশগুলোর অনেকে।

এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য। এই প্রতিপাদ্য অবশ্যই পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া যে নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী আচরণ করছে, পুরোপুরি তার বিপরীত। এ কারণেই আফ্রিকার নেতাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ, তারা যেন অসাবধানতাবশত ইউক্রেন আগ্রাসনের ঘটনাটির অনুমোদন না দেন। এবং কোনো ধরনের সমস্যাজনক বাণিজ্য চুক্তি না করেন। ২০১৯ সালে প্রথম যখন আফ্রিকা মহাদেশের ৪৭ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সমুদ্র তীরবর্তী শহর সোচিতে প্রথম রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামের সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন, সে সময় প্রতিবেশী দেশের ওপর পুরো মাত্রায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরু করেনি রাশিয়া।তবে আফ্রিকার নেতারা সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবছেন না।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব সংকুচিত হয়ে যায়। চীনসহ অন্য শক্তিগুলো সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃতপক্ষে চীন এখন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আফ্রিকা মহাদেশে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। পক্ষান্তরে ২০১৯ সালে পুতিন আফ্রিকার জন্য সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র কারখানা রসোবোরননেক্সপোর্টের সঙ্গে সম্পাদিত অস্ত্রচুক্তি। এ ছাড়া আফ্রিকার ৩০টি দেশের সঙ্গে সম্পাদিত সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা চুক্তি। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইউয়ারি মুসেভিনি ও জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়ার মতো স্বৈরশাসকদের কাছে এই চুক্তির বিশাল মূল্য রয়েছে।

আফ্রিকায় আসা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশ রাশিয়ার। চীন কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় আফ্রিকায় রাশিয়ার বিনিয়োগ প্রকৃতপক্ষেই বামনাকৃতির। এর পরিমাণ আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরো বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ এবং চীনের তুলনায় ৬ শতাংশের বেশি নয়। রাশিয়ায় রপ্তানির তুলনায় ৫ গুণ বেশি আমদানি করে আফ্রিকা। ২০১৯ সালে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছিল যে, চীনের সঙ্গে তারা বাণিজ্য দ্বিগুণ বাড়াবে। কিন্তু সেটা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ রাশিয়ার ব্যাংক, তেল শোধনাগার ও সামরিক রপ্তানির ওপর সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার জ্বালানি ও সামরিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও অবকাঠামো খাত লক্ষ্যবস্তু করেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ সম্পদশালী ব্যক্তিদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আফ্রিকা মহাদেশকে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে মরিয়া।

আফ্রিকান শান্তি উদ্যোগ এবং এই সফরের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা। তিনি পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন টেলিফোনে। এ ছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেসকেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্রিফিং করেছেন। রাশিয়া এবং ইউক্রেন এখন পর্যন্ত শান্তি আলোচনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, তবে তারা আফ্রিকান নেতাদের এ সফরের ব্যাপারে আগ্রহী। আসল প্রশ্ন হলো, যাদের মধ্যে এ যুদ্ধ হচ্ছে সেই রাশিয়া ও ইউক্রেন আদৌ আলোচনার টেবিলে এসে বসবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

raihan567@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION